সকলের জন্য কাজ করে এমন গোপনীয়তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা

মিউনিখের Google Safety Engineering Center হল গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গ্লোবাল হাব। কীভাবে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণের কথা মাথায় রেখে Google-এ প্রোডাক্ট তৈরি করা হয় তা ইঞ্জিনিয়ার উইল্যান্ড হফেল্ডার ও স্টেফান মিকলিৎজ ব্যাখ্যা করে বোঝান।

উইল্যান্ড হফেল্ডার যখন Google-এ নতুন চাকরির অফার পান তখনও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন। তিনি জার্মানি থেকে সিলিকন ভ্যালিতে চলে যান ও ১২ বছর ধরে Mercedes-Benz সহ বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করেন। ২০০৮ সালে সবকিছু বদলে যায়। হফেল্ডারের মার্কিন বন্ধু ও সহকর্মীরা তাঁর নতুন পদ ও নিয়োগকারীকে নিয়ে খুব উৎসাহিত ছিলেন। সবাই মনে করেছিলেন তাঁর কর্মস্থল হবে মাউন্টেন ভিউ, ক্যালিফর্নিয়া। কিন্তু আসলে তা ছিল মিউনিখ, জার্মানি। জার্মানিতে থাকা তাঁর বন্ধুরা এনিয়ে খুব একটা উৎসাহিত ছিল না। হফেল্ডার সাধারণ অভিনন্দনসূচক মেসেজ পাচ্ছিলেন কিন্তু পাশাপাশি তাঁর কিছু জার্মান বন্ধু এ নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করছিলেন। "Google" নাম উচ্চারণ করলেই তারা তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। কিন্তু হফেল্ডার জানেন, ইউরোপিয়ানরা – বিশেষত জার্মানরা – তাদের ডেটার ব্যাপারে কতটা সংবেদনশীল।

Google-এর ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হফেল্ডার, মিউনিখ অফিসের ক্যান্টিনে বসে আছেন। এটির রুচিপূর্ণ সাজসজ্জা ও মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত জানলা দেখলে জায়গাটিকে খোলামেলা রেস্তোরাঁ বলে মনে হয়। পুরো ক্যান্টিনে যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে এবং তার মধ্যে থেকে যে ভাঙা ভাঙা কথোপকথন কানে ভেসে আসছে, তাতে এটি স্পষ্ট যে মিউনিখের "Googler-দের" মূল ভাষা ইংরেজি। সিলিকন ভ্যালির প্রভাব সেখানেই থেমে যায়নি – ২০১৬ সালে যে ইঁটের বাড়ি উদ্বোধন করা হয় সেটিতে ফিটনেস স্টুডিও, কফি বার, বিলিয়ার্ড রুম ও লাইব্রেরি আছে। এই শাখাতে সারা পৃথিবীর প্রায় ৭৫০ জন কর্মচারী কাজ করেন এবং এদের মধ্যে প্রায় সকলেই সফ্টওয়্যার ডেভেলপার। তাদের অনেক সময়ই সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতে হয়, কারণ মাউন্টেন ভিউতে Google-এর হেডকোয়ার্টারে কর্মরত সহকর্মীদের সাথে একমাত্র সন্ধ্যার পরেই ভিডিও কনফারেন্স করা যেতে পারে।

প্রধান লক্ষ্য হল ব্যবহারকারীদের ডেটা কীভাবে ব্যবহার করা হয় সেই বিষয়ে যেন সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা থাকে ও তারা যেন সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন

এতকিছু সত্ত্বেও Google-এর মিউনিখ অফিস বেশ জার্মান বলেই মনে হয় – স্থানীয় সাবওয়ে স্টেশনের মতো কনফারেন্স রুম বা ক্লাসিক বাভারিয়ান কাঠের প্যানেল সহ রুমের মতো অনেক মজাদার সজ্জা এই অনুভূতি জাগিয়ে তোলার জন্য কিছুটা দায়ী। কিন্তু হফেল্ডারের কাছে যেটাকে সবচেয়ে বেশি জার্মান বলে মনে হয় তা হল মিউনিখ অফিসের ইঞ্জিনিয়ারিং টিম। যেটাকে তিনি গর্ব সহকারে "জার্মানিতে হওয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা" বলেন। হফেল্ডার বলেন "এখানে, মিউনিখে আমরা Google-এর পাশাপাশি সারা বিশ্বের ব্যবহারকারীদের জন্য – ডেটার গোপনীয়তা সুরক্ষিত রাখা – প্রোডাক্ট ও পরিষেবা তৈরি করছি"। প্রধান লক্ষ্য হল ব্যবহারকারীদের ডেটা কীভাবে ব্যবহার করা হয় সেই বিষয়ে যেন সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা থাকে ও তারা যেন সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এই কাজ করার জন্য জার্মানির থেকে ভালো জায়গা আর কিছুই হতে পারে না।

ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিরেক্টর স্টেফান মিকলিৎজ সারা বিশ্বে Google-এর সব প্রোডাক্টের ডেটা গোপনীয়তা স্ট্যান্ডার্ডের দায়িত্বে আছেন। তিনিও মিউনিখের অফিসে কাজ করেন। তিনি ২০০৭ সালে টিমে যোগ দিয়েছেন এবং মিউনিখ অফিসের সবচেয়ে প্রথম দিকের Googler-দের মধ্যে অন্যতম। মিকলিৎজ ও তার টিম অরিজিনাল 'আমার অ্যাকাউন্ট' পরিষেবা ডেভেলপ করেন এবং এটি পরবর্তীকালে Google অ্যাকাউন্ট নামে পরিচিত হয়। Google অ্যাকাউন্ট আছে এমন যেকোনও ব্যক্তি ছাড়াও যিনি শুধু Google-এর সার্চ ইঞ্জিন ও YouTube ব্যবহার করেন তিনিও এই ডিজিটাল ককপিট ব্যবহার করতে পারবেন। Google অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সহজে সেটিংস ম্যানেজ করা যায়। এছাড়াও, একজন ব্যবহারকারী বাইরের আক্রমণ থেকে তার ডেটা কতটা সুরক্ষিত আছে তা জানতে, নিরাপত্তা চেক-আপ রান করতে পারেন এবং তার কোন ব্যক্তিগত তথ্য Google সার্ভারে সেভ করা থাকবে বা থাকবে না সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে, গোপনীয়তা চেক-আপ ব্যবহার করতে পারেন।

"আমরা Google এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ব্যবহারকারীদের জন্য মিউনিখে ডেটা গোপনীয়তা সংক্রান্ত প্রোডাক্ট ও পরিষেবা তৈরি করছি।"

উইল্যান্ড হলফেল্ডার

মিকলিৎজ বলেন, "আমাদের ইচ্ছা ছিল এই ধরনের সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য একটি সেন্ট্রাল হাব গড়ে তোলা।" "ব্যবহারকারীরা যাতে তথ্যে ভারাক্রান্ত না হন সেই জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলির উপর নজর রেখে আমরা সেটিং কনফিগারেশনের সব বিকল্প সহ উত্তর দুটি পৃষ্ঠা পৃষ্ঠায় একসাথে দেখাতে চেয়েছিলাম।" মিকলিৎজ এইমাত্র Google-এর কর্মচারীদের জন্য তৈরি ছোট্ট কিচেন থেকে এক কাপ কফি নিয়ে এসেছেন। এটিকে "মাইক্রোকিচেন" বলা হয় এবং এখানে ছ' ফুট উঁচু ফ্রিজ সবসময় বিভিন্ন পানীয় দিয়ে ভর্তি থাকে। ফ্রিজের উপরের দুটি তাক যে মিনারেল ওয়াটারের বোতল দিয়ে ভর্তি সেটি কাঁচের দরজা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায়। ফ্রিজের বাকি অংশ ঝাপসা কাঁচ দিয়ে ঢাকা। প্রথমে থাকে স্পার্কলিং জুস, তারপরে সাধারণ জুস ও আইসড টি এবং সবশেষে নিচের তাকে অস্বাস্থ্যকর কোল্ড ড্রিঙ্কস রাখা হয়। মিকলিৎজ কৌতুক করে বলেন, "আমরা ইঞ্জিনিয়াররা কিছুই ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে পছন্দ করি না।"

উইল্যান্ড হলফেল্ডার (ডানদিকে) Google Germany-র ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। তার সহকর্মী স্টেফান মিকলিৎজ ২০১০ থেকে Google-এর বিশ্বব্যাপী গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা টিমের নেতৃত্বের ভূমিকায় আছেন। কোম্পানি কীভাবে ডেটা ম্যানেজ করে সেটি জানতে আগ্রহী যেকোনও ব্যক্তিকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য এদের চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ হতেই পারেন না।

হফেল্ডার ও মিকলিৎজের মতে ইন্ডাস্ট্রিতে আর কোনও কোম্পানি অনলাইন আক্রমণের হাত থেকে ব্যবহারকারীর ডেটা সুরক্ষিত রাখার জন্য এত চেষ্টা করছে না। এছাড়াও, এটি সত্যি যে Google-এর সার্ভার পরিকাঠামো পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ পরিকাঠামোগুলির মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিরাপত্তা সিস্টেমটি অত্যন্ত জটিল এবং একাধিক লেভেল আছে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ডেটা সেন্টারে ডেটা এনক্রিপ্ট করা অবস্থায় সেভ করা থাকে – এই জায়গাগুলি সবচেয়ে সুরক্ষিত জেলখানার মতো হয়। হফেল্ডার বলেন, "কেউ বায়োমেট্রিক্স দ্বারা সুরক্ষিত ডেটা সেন্টারগুলির মধ্যে কোনওটিতে আপনার ইমেল সহ হার্ড ড্রাইভ দেখতে পেলেও সেটি নিয়ে কিছু করতে পারবেন না। সেটির সব তথ্য সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ডেটা সেন্টারে বিতরণ করা আছে – এবং এটি এনক্রিপ্ট করা থাকে।" একইসাথে এই ধরনের সব ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও হ্যাকাররা Google-এর ইন্টারফেস বা প্রোডাক্টে কোনও দুর্বলতা খুঁজে পেলে, কোম্পানি সেই তথ্যের বিনিময়ে ভালো অর্থ পুরস্কার দেয়। তাই, সুরক্ষাতে কোনো দুর্বলতা খুঁজে পেলে হ্যাকাররা সেটিকে কাজে লাগিয়ে সাইবার অপরাধ না করে, কোম্পানিকে সেটির বিষয়ে জানিয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করে।

"আমাদের ইচ্ছা ছিল গোপনীয়তা ও সুরক্ষা সম্পর্কে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য একটি সেন্ট্রাল হাব গড়ে তোলা।"

স্টেফান মিকলিৎজ

হফেল্ডার ও মিকলিৎজের সাথে কথোপকথন থেকে দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখা দরকার। প্রথমত, কোনও ব্যবহারকারী Google-এ ইমেল অ্যাকাউন্ট খুললে বা ক্লাউড স্টোরেজে ফটো আপলোড করলে তার মেসেজ বা ফটোগুলি যতটা নিরাপদ থাকা সম্ভব ততটাই থাকে। দ্বিতীয়ত, Google-এর সাহায্যে কোনও ব্যবহারকারী ওয়েব সার্ফ বা সার্চ করলে Google কোন ডেটা সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে পারবে তা তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। হফেল্ডার মনে করেন, "ব্যক্তিগতভাবে আমার মোবাইল ফোনে ট্রাফিক আপডেট দেখানো এবং বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে আমার সুবিধাই হয়, যেমন হাইওয়েতে ট্রাফিক জ্যাম আছে তাই ফ্লাইট ধরতে হলে আমাকে এখনই বেরোতে হবে।" "কিন্তু, এই ফিচার চালু করতে চান কিনা সেই বিষয়ে প্রত্যেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।"

Google Chrome জিঞ্জারব্রেড হার্ট: মিউনিখের Google অফিসের ঘরগুলির সজ্জা বেশ মজাদার ও প্রাণবন্ত।

একই কথা বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। Google এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি উপার্জন করে। ডেটা বিজ্ঞাপনকে আপনার কাছে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলতে সাহায্য করে -- আপনি ধূসর রঙের সোফা খুঁজলে সেই প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারে এমন বিজ্ঞাপন আপনাকে দেখানো হয়। কিছু ব্যবহারকারী এটি উপযোগী বলে মনে করেন, বাকিদের কাছে এটি বিরক্তিকর। মিকলিৎজ বলেন, কোনও ব্যক্তি পছন্দ অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দেখার এই ফিচার সহজেই বন্ধ করে দিতে পারেন। "অবশ্যই, Google অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে" এটি বন্ধ করা যাবে বলে তিনি জানান। যেসব ব্যবহারকারী এই ফিচার বন্ধ করে দেন তাকে বিজ্ঞাপন দেখানো হলেও, তার আগ্রহ অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দেখানো হবে না। এর সাথে হফেল্ডার যোগ করেন, "ডেটা ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের জন্য বিজ্ঞাপনকে আরও উপযোগী করে তোলা হয়।" "কিন্তু, আমরা কোনও ব্যক্তিগত ডেটা বিক্রি করি না।"

ফটোগ্রাফ: মিরজিক ও ইয়ারিশ

সাইবার সুরক্ষা উন্নত করা

বিশ্বের অন্য কারোর তুলনায় আমরা কীভাবে অনলাইনে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে নিরাপদ রাখি তা জানুন

আরও জানুন